ভালোবাসার গল্প।পর্ব ৫

                         গল্প: ভালোবাসা

পর্ব:৫ (শেষ পর্ব)

ফাতেমাকে নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ খুব সুখেই আছি।
শ্রুতিকে বিদায় জানানোর পর দোটানা সম্পর্ককে
সমুদ্রের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছি। মিষ্টি ভালোবাসার
মাঝে দুষ্টুমিগুলো সুখ এনে দেয় আমাকে।
আমি জানি না ফাতেমা এতে সুখ পায় কিনা! তবে মনে
প্রাণে সে আমাকে ভালোবাসে, একথাটা ঢের বুঝতে
পারি। প্রায়ই পাঁজাকোলা করে ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে
দু'জন দু'জনের খুব কাছে এসে দু'জন দু'জনার মধ্যে মিশে
যাই। হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দেই একে অপরকে।
তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। কারণ
প্রথম এক বছর কিছুই দিতে পারি নি ফাতেমাকে। কত
কষ্টই না করেছে মেয়েটা।
স্বামীকে পাবার ব্যাকুলতা সবসময় থাকলেও আমি
ছিলাম ছন্নছাড়া। পরকীয়াতে ব্যস্ত থেকে ঠকিয়েছি
নিজেকে, ঠকিয়েছি আমার পবিত্র স্ত্রী ফাতেমাকে।
মাঝে মাঝে বিষয়টা খুব ভাবায় আমাকে। খুব চিন্তামগ্ন
হয়ে যাই। ফাতেমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো একদিন,
- তুমি কিসের এত টেনশন করো? কিছু হয়েছে? আমার
সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারো।
- আমার কৃতকর্ম আমাকে ভাবায় ফাতেমা। জানি না এর
জন্য ক্ষমা পাবো কিনা?
- কেন পাবে না! আমি তো তোমাকে ক্ষমা করেছি।
তাছাড়া আমরা তো বেশ আছি। আমি তোমার জন্য প্রতি
নামাযে আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তোমার যেন কিছু
না হয়। আর তবুও যদি কোন পাপবোধ তোমাকে কুড়ে কুড়ে
খায় তাহলে তাহাজ্জুদ পড়ে ক্ষমা চাও, নিশ্চই তিনি
তোমাকে ক্ষমা করবেন। কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তা
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য অধীর
আগ্রহে বসে থাকে। কিন্তু আফসোস বান্দাই কাঁদে না।
ইসলামীক বিষয়গুলো আমি অধীর আগ্রহে ফাতেমার
কাছে শুনি। কি মিষ্টি স্বর ফাতেমার! কি বুঝানোর
ক্ষমতা!
ওর মায়াজালে আমি আবদ্ধ হয়ে গেছি।
আমি মনে মনে ভাবি, একজন নারী তার স্বামীকে
পরিবর্তন করতে সক্ষম। খারাপ পথ থেকে ভালো পথে
আনতে পারে। মনের কলুষতাকে দূর করতে পারে।
যেমন ফাতেমা আমাকে পরিবর্তন করেছে, পরিবর্তন
করেছে আমার পরিবারের সবাইকে। যে বাড়িতে কেউ
পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তো না সে এখন তাহাজ্জুদ অবধি
আদায় করে।
সত্যি সেই কথাটাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে, 'সংসার
সুখের হয় রমণীর গুনে।'
ঠিক তেমনি গ্রামের অর্ধ শিক্ষিত বুদ্ধিমতী মেয়ে
ফাতেমা তার মায়াজালে সকলের মন জয় করে
সংসারকে করেছে পরিপূর্ণ। ওসিলা হয়ে ধরা দিয়েছে
মনের আঙিনায়।
ঝলমল করছে পুরো সংসার। প্রতিটি অন্ধকার কোণা
আলোয় পরিপূর্ণ হয়েছে। সুখের কোন অভাব নেই।
.
এইতো সেদিন ফাতেমাকে কানে কানে এসে বললো,
- এই শুনছো?
- কী বলো?
- ইয়ে আমার বলতে লজ্জা করছে।
আমি ইসলামীক বই পড়ছিলাম। বইটা বন্ধ করে মুচকি
হেসে জিজ্ঞেস করলাম,
- আমার কাছে তোমার আবার কিসের লজ্জা? বলে ফেল।
- আমি বলতে পারবো না।
- তাহলে খাতায় লিখে দাও।
টেবিলের উপরে কি যেন লিখে রান্নাঘরের দিকে দৌঁড়
দিলো ফাতেমা। আমি লেখাটা না দেখেই হেসে
ফেললাম। মনে মনে ভাবলাম কি এমন কথা যে, মুখে বলা
গেল না! লিখে বলতে হলো!
আমি টেবিল থেকে খাতাটা নিয়ে দেখেই 'ইয়াহু' বলে
চিৎকার দিয়ে উঠলাম। খাতার পাতায় লেখা ছিলো,
"সংসারে নতুন অতিথি যোগ হচ্ছে। বরণ করার জন্য
প্রস্তুত থেক।"
আমার চিৎকার শুনে বাবা দৌঁড়ে আসলেন। আমার এত
খুশি আর খাতায় লেখাটা দেখে বাবাও আমাকে
জড়িয়ে অভিনন্দন জানালো। আমার থেকেও বেশি খুশি
হয়েছেন বাবা।
তার নাতি-নাতনির শখ অবশেষে পূরণ হচ্ছে। তিনি
আনন্দে গদগদ হয়ে সবাইকে খবরটা জানাতে থাকলেন।
আমি রান্নাঘরে গিয়ে ফাতেমাকে জড়িয়ে ধরলাম।
- এই কি হচ্ছে এসব? বাবা দেখবেন তো।
- আমার বউকে আমি জড়িয়েছি, এতে কার কি! তাছাড়া
বাবা বেলকনিতে সবাইকে ফোন করছে, তাই দেখবে না।
- এখন তো ছাড়ো।
- নাহ ছাড়বো না। তোমার এসব কাজ এখন চলবে না। পূর্ণ
বিশ্রামে থাকবে তুমি।
- এখনো পূর্ণ বিশ্রামের সময় আসে নি। তুমি রুমে যাও।
আপাতত আর ন্যাকামি করো না।
আমি মনে মনে একটু ভ্যাংচি কাটলাম। বিড়বিড় করে
বললাম,
- একটু রোমান্স করবো তারো সুযোগ নেই। কি মহিলারে
বাবা!
আমার বিড়বিড় করা কথা শুনে চোখ দু'টো বড় বড় করে
বললো,
- এই তুমি কি বললে হ্যাঁ? আরেকবার বলো দেখি?
- না কিছু বলি নি তো।
- আমি শুনলাম তুমি কি যেন বলছিলে।
- ওহ হ্যাঁ, বললাম তরকারির সুগন্ধ ছড়িয়েছে।
- এই আমি ভাত বসিয়েছি, তরকারি নয়।
আমি ভুল বলেছি। চট করে ঘরের দিকে দৌঁড় দিয়ে
বিছানায় ঝাঁপ দিলাম। ফাতেমা পেছন থেকে হাসছে।
ফাতেমা কনসিভ করার পর থেকে ওর নিয়মিতভাবে যত্ন
নেয়া শুরু করলাম। ঠিকমত চেকআপ, ডাক্তার দেখানো,
ওষুধ খাওয়ানো ইত্যাদি।
ডাক্তারসাহেব দ্বিতীয়বারের মতন রিপোর্ট দিলেন
ফাতেমা সম্পর্কে। নাহ! কোন সমস্যা নেই ফাতেমার,
সবকিছু ঠিকঠাক আছে। তবে মজার ব্যাপার এটা যে,
একজন নয় দু'জন আসতে চলেছে সংসারে। মানে জোড়া
সন্তান!
মেঘ না চাইতেই যেন বৃষ্টি! দু'টো ফুটফুটে বাচ্চা সারা
বাড়ি খেলবে, ঘুরবে, ছোটাছুটি করবে এসব ভাবতেই
মনের মধ্যে আগডুম বাগডুম বাজছে। মাঝে মাঝে মনে হয়
দরজা দিয়ে একলা নাচ করি।
.
অফিসে খুব বড় একটা ডিল করছি। প্রজেক্টটা মোটামুটি
বড় ধরনের। বাবা বারবার ফোন দিচ্ছেন কিন্তু আমি
কেটে দিচ্ছি। একটু অস্বস্তিবোধ করলাম। মেসেজ
পাঠিয়ে দিলাম, 'মিটিংয়ে আছি বাবা। পরে কথা
বলছি।'
মেসেজ দেয়ার পরপরই রিপ্লে আসলো, 'বউমা খুব অসুস্থ।
ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছি। তাড়াতাড়ি চলে আয়।'
মেসেজটা পাবার পর মিটিংয়ে একেবারে সংক্ষিপ্ত
করে ক্লিনিকের দিকে ছুটলাম। গিয়ে দেখি বাবা
বাইরে।
- এখন কি অবস্থা বাবা?
- অপারেশন হচ্ছে।
আমি বেশ ঘামছি। শার্ট ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে গেছে।
বাবা আমার পাশে বসে বললেন,
- চিন্তা করিস না বাবা। ফাতেমার জন্য দোয়া কর।
বাবার কথামতো মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম।
সময়টা যেন কাটছেই না। বেশকিছুক্ষণ পর ডাক্তার
হাসিমুখে বের হলেন। আমি তার দিকে ছুটলাম।
- কনগ্রেটস মিঃ রোহান, আপনি দু'টো মেয়ে সন্তানের
বাবা হয়েছেন। মা, মেয়েরা সবাই ভালো আছে।
বাবা আমাকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। আমার চোখে
সুখের পানি। কিছুক্ষণ পর ফাতেমার কাছে গেলাম।
বাবা বারবার বাচ্চা দু'টোকে দেখছেন আর বৃথা কথা
বলার চেষ্টা করছেন।
আমি ফাতেমাকে মিনমিন করে বললাম,
- এখন কেমন আছো তুমি?
- ভালো। তুমি খুব টেনশনে ছিলে তাই না?
- হুম, খুব।
- তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এত কেন
ভালোবাসো আমাকে?
- জানি নাহ, তবে এতটুকু জানি তুমি আমার পৃথিবী।
আমি ফাতেমার খুব কাছে গেলাম। ফিসফিস করে
বললাম,
- আমাদের ভালোবাসার ফসল দু'টো কিন্তু দেখতে
আমার মতোই হয়েছে।
- দেখতে হবে মেয়ে দু'টোর বাবা কে!
- এখন কি হবে?
- কি হবে?
- শুধু প্রেম-ভালোবাসা।
- গত দেড় বছর কি ছিলো?
- শুধু ভালোবাসা ছিলো।
- আর এখন?
- এখন ডাবল হবে। কারণ আমাদের মেয়ে ডাবল। এজন্য
ভালোবাসাও ডাবল। শুধু ভালোবাসা ভালোবাসা।
- যাহ, তুমি না পারোও বটে।
ফাতেমার কথা শুনে ওর কপালে দু'টো ভালোবাসা এঁকে
দিলাম। লজ্জায় মুখটা লুকিয়ে ফেললো ফাতেমা। আমিও
মুচকি হাসলাম। বাবা এখনো বৃথা কথা বলেই যাচ্ছেন।
চিন্তাদূর করার জন্য নিচে নেমে আসলাম।
চারদিকটা কি অন্ধকার! ফ্লাটে ফ্লাটে লাইটগুলো
টিমটিম করে আলো ছড়াচ্ছে। হালকা বাতাসে মনটা
শীতল হয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত আমিও বাবা হলাম। তবে
ফাতেমাকে বলা একটা কথা আমাকে খুব হাসাচ্ছে,
"এখন থেকে সব ডাবল হবে। ভালোবাসাও ডাবল হবে। শুধু
থাকবে ভালোবাসা ভালোবাসা।"
কথা মনে করছি আর হাসছি। মুচকি হেসে আকাশের
দিকে তাকিয়ে বললাম, 'অবশেষে সব পেলাম আল্লাহ।
ধন্যবাদ শূন্যতাকে পূর্ণতায় রুপ দেয়ার জন্য।'
(সমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

বোনের ভালোবাসা

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ১

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ২