ভালোবাসার গল্প।পর্ব ১
গল্প: ভালোবাসা
পর্ব:১
বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান হবার কারণে
লেখাপড়ার ইতিটা বিদেশেই টেনেছি। বিদেশি
কালচার দেখে শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে দেশে ফিরে
আসলাম। নাড়িরটান বলে কথা! হাজার হোক আমি
বাঙালী। বাংলা ভাষা আমার হৃদয়ের প্রতিটা শিরা-
উপশিরায় গেঁথে আছে। বিদেশের মাটিতে বসে সবসময়
দেশের কথা মনে পড়তো, পরিবারের কথা মনে পড়তো,
বন্ধুবান্ধবদের কথা মনে পড়তো।
তাইতো বাবার চাপে লেখাপড়া শেষ করেই দেশে ফিরে
এসেছি। আমি দেশেই থাকতে চেয়েছিলাম, বড়লোক
বাবার ছেলে বলে নিজের ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে
বিদেশেই পড়ে থাকতে হয়েছে।
মাকে ছোটবেলায় হারিয়েছি। মাকে খুব ভালোবাসতেন
বলে দ্বিতীয়বারের মতন কবুল বলার মন মানসিকতা
বাবার তৈরি হয়নি। তখন খুব বেশি না বুঝলেও এতটুকু
বুঝেছি বাবা মায়ের শেষ স্মৃতিটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে
চায়।
দাদুভাই, বড় আব্বু, জেঠাইমা কত করে বুঝালো বাবাকে,
কিন্তু বাবা রাজি হলেন না।
আস্তে আস্তে যখন বড় হতে থাকলাম তখন মাঝে মাঝে
বাবাকে একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকতে দেখতাম। অবশ্য সেই
ঘরে কেউই ঢুকতো না। বাবার বারণ ছিলো। শুনেছি
মায়ের গানের গলা ভারী মিষ্টি ছিলো। মাঝে মাঝে
মা গাইতেন আর বাবা তার সাথে সুর মেলাতেন।
তখন যদি দু'জনকে দেখতে পেতাম তাহলে হয়তো আমার
জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। বাবা আজও মিনমিন
করে গান গায়,
"ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় নয়,
তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়।"
সত্যি তো বাবা মায়ের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। বাবা
প্রায়ই মায়ের কবরের পাশে বসে কি যেন বকেন। সবাই
তাকে পাগল বললেও আমি কিছুটা বুঝি।
সত্যিকথা বলতে বাবা মাকে ভালোবেসে বিয়ে
করেছিলেন। তাদের প্রথম ভালোবাসার ফসল আমি। তবে
মাকে আমি কাছে পেয়েছিলাম মাত্র ৩ বছর।
হাস্যকর হলেও সত্যি যে মা টাকার জন্যই মারা
গিয়েছিলেন। তখন বাবা ছোটখাট কোম্পানিতে জব
করে সংসার চালাতো। ছোট্ট ঘরে কোন কিছুরই কমতি
ছিলো না। কিন্তু শেষপর্যন্ত টাকার কাছে বাবা হেরে
গেলেন।
এরপর জেদের বশে বাবা টাকা কামাতে লাগলেন।
টাকার উৎস কোথায় আমি জানতাম না।
তবে বাবা খুব কম সময়ে খুব বড়লোক হয়ে গেলেন। টাকার
দুঃখ ঘুচলো বটে কিন্তু সংসারে সুখ ফিরলো না। আমাকে
নিয়ে শুরু হলো বাবার নতুন যুদ্ধ। আমাকে মানুষের মতন
মানুষ করার যুদ্ধ।
তাইতো আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে তিনি নিশ্চিতে
অফিস করতেন। বিদেশি সংস্কৃতি দেখে বরাবরই আমার
খারাপ লাগতো। বাবাকে বিদেশে না থাকার কথা
বললে তিনি ভীষণ রাগ করেন। তারপর থেকে অনিচ্ছা
সত্ত্বেও পড়ে থাকতে হয়েছে।
.
এখন আমার লেখাপড়া শেষ। নিজেদের এত বড় ব্যবসা
থাকলে জব করার প্রশ্নই ওঠে না। খুব দ্রুত বাবা সবকিছু
আমার হাতে তুলে দিয়ে শান্ত হতে চাইলেন। কিন্তু
নিজের কাছে আমাকে নিতান্তই ছোট মানুষ মনে হয়
তাই সবটা নিলাম না। বাবার সাথে অফিসের কাজ
ভাগাভাগি করে নিলাম।
বাবা সারাদিন অফিসে কাটালেও কাজ শেষ করে
আমিই আগে চলে আসি। বাড়িতে ফিরেই রান্না করি।
রান্না করার জন্য কাজের লোকের তো অভাব নেই তবুও
অন্যের রান্না করা খাবার ঠিক আমার মুখে মুখরোচক হয়
না। বাবা হয়তো চাপে পড়ে এতদিন খেয়েছে কিন্তু
আমি খেতে পারবো না।
বিদেশেও সময় পেলেই রান্না করে খেতাম, বাঙালী
রান্না। আমার রান্না করা দেখে বাবা মুচকি হাসেন।
হাসলেই বা কি!
রান্না তো খারাপ হয় না। তবে বাবার এমন হাসার অর্থ
কিছুটা হলেও আমি বুঝি। তবে আপাতত এসব সায় দেই না।
সেদিন তো বলেই ফেললেন,
- রোমান বাবা একটা বিয়ে করেই ফেল। আর কতদিন
বাড়িটা খালি পরে থাকবে বল।
- কি যে বলো বাবা, বাড়িটা খালি কই? তুমি আছো আমি
আছি, রহিমের মা আছে, শফিক চাচা আছে।
- এত প্যাচ মেরো না তো। আমি আর কয়দিনই বা বাঁচবো।
নাতি-নাতনির মুখ কি দেখবো না? তোমার তো উপযুক্ত
বিয়ের বয়স হয়েছে।
- দেখ বাবা, আমি আপাতত বিয়ে করছি না। বিয়ে করার
জন্য আরো ৪ বছর লাগবে। আমার সময় চাই।
বাবা চুপ করে থাকেন। আমি একটা মেয়েকে
ভালোবেসেছি দেশে এসেই। মেয়েটা ডানাকাটা পরীর
মতন। কি মিষ্টি হাসি! তবে মেয়েটার কাছে একটাই
কমতি মনে হলো, বাঙালিপনা। তবে তা বানিয়ে নিতে
পারবো। একটা সময় শ্রুতির সাথে সম্পর্কটা হয়েই গেল।
বড়লোক বাবার ছেলে বলে হয়তো খুব দ্রুত সবকিছু ঠিক
করে নিয়েছে।
.
বেশকিছু দিন চুটিয়ে প্রেম করার পর বুঝলাম মেয়েটার
বেখেয়ালিপনা অনেক। তবুও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা
দিয়ে তাকে আপন করে নিতে চেয়েছি। বিয়ের পর
আস্তে আস্তে পরিবর্তন করতে চেয়েছি। তবুও কেন
জানি মনে হচ্ছিলো মেয়েটা বেশ জেদি। কখনো কিছু
করতে চাইলে করবেই। তবুও প্রথম স্বপ্ন দেখা তাকে
নিয়েই।
সকলের মুখে একটা কথা শুনি, 'প্রথম ভালেবাসা ভোলা
যায় না।'
আমিও হয়তো শ্রুতিকে ভুলতে পারবো না। ওর সাথে
যতটুকু মিশেছি ততবারই বুঝেছি মেয়েটাও আমাকেই
ভালোবাসে।
বাবাকে কথাটা বলার আগেই বাবার ডাক পড়লো,
- রোহান, বেশ কিছুদিন থেকে আমার শরীরটা ভালো
যাচ্ছে না। আমি প্রতিদিনই তোমার মাকে স্বপ্নে
দেখি, সে আমাকে ডাকছে। হয়তো আমি আর বেশিদিন
বাঁচবো না। আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবি বাবা?
- বাবা তুমি এসব কি বলছ? তোমার কিচ্ছু হবে না।
- আগে বল পূরণ করবি কিনা?
- আচ্ছা বলো, তোমার কথা কি আমি ফেলতে পারি?
বাবা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ চুপ
থেকে গলা খাকড় দিয়ে বললেন,
- আমার গ্রাম্য বন্ধুর মেয়ে, নাম ফাতেমা। গতবার যখন
দেশে গিয়েছিলাম তখন তাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। আমি
চাই তুমি তাকে বিয়ে করে ঘরে তুলো।
বাবা আমার হাত দু'খানা চেপে ধরলো। বাবার চোখে
হালকা পানি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। হয়তো সত্যি সত্যি
বাবার হৃদয়টা শূন্যতায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
বাবার কথায় শ্রুতির কথা পুরোটা ভুলে গেলাম। কোন
কথা না বলে বাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। এতদিন
বাদে বাবার চোখে স্পষ্ট পানি দেখতে পেলাম। এই
মূহুর্তে কিভাবে শ্রুতির কথা বলি?
এদিকে শ্রুতি আরো এক বছর সময় চেয়েছে তার
লেখাপড়া শেষ করার জন্য। সবদিক দিয়েই চাপে আছি।
আজ মাকে খুব মনে পড়ছে। স্মৃতিগুলো বেশ আবছা!
মায়ের মুখটা স্পষ্টতর নয়।
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। শ্রুতিকে ফোন দিলাম। কথা
বলতে বলতে বেলকনিতে আসলাম। দূরে পুকুরঘাটে কাকে
যেন দেখতে পেলাম।
বাবা ভালো গিটার বাজাতেন। পুকুরঘাটে বসে এই মধ্য
রাতে তিনি সেটাই করছেন। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাব
ি পরে গিটার নিয়ে হালকা সুর তোলার চেষ্টা করছেন।
আমি বাবার কষ্টটা বুঝি। এতটা বছর মায়ের স্মৃতিকে
আঁকড়ে ধরে তিনি বেঁচে আছেন। বাবা গান ধরেছেন,
'আমার মতন এতো সুখী, নয়তো কারো জীবন।
কি আদর স্নেহ ভালোবাসা, জড়ালে মায়ার বাঁধন।'
আমি শ্রুতির ফোনটা কেটে দিয়ে বাবার পাশে গিয়ে
দাঁড়ালাম। বাবা গেয়েই চলছেন। চোখ দিয়ে টপটপ করে
পানি ঝরছে। আমি বাবার কাঁধে হাত স্পর্শ করলাম।
বাবা পিছনে ফিরে আমাকে দেখা মাত্রই চোখের জল
মুছার চেষ্টা করলেন।
গিটারটা রেখে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। শূন্যতা
মানুষকে এত দূরে নিয়ে যেতে পারে তা জানা ছিলো
না। কারো স্বামী হিসেবে হয়তো বাবা ব্যর্থ। তবে
পিতা হিসেবে তিনি কোনক্রমেই ব্যর্থ নন। আমি বাবার
চোখে চোখ রেখে তার অশ্রুকণাগুলো মুছে মেকি হাসার
চেষ্টা করলাম।
(চলবে)
Comments
Post a Comment