ভালোবাসার গল্প।পর্ব ৩

                    গল্প: ভালোবাসা

 পর্ব:৩

শুরু হলো ফাতেমা আর আমার নতুন যুদ্ধ। যুদ্ধ না বলে একে
অন্য নামে ডাকার মতন নাম আমার হৃদয়ে আবিষ্কৃত হয়নি।
ফাতেমা অনেক ভালো মেয়ে। পাঁচ ওয়াক্ত নামায
আদায় করে, নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ে, বাবার সেবা
করে।
আড়ালে থেকে আমারো সেবা করাটা ছাড় দেয় না।
গোসলের সময় তোয়ালে, প্যান্ট, শার্ট রেডি করে দেয়া
কিংবা মানিব্যাগের টাকা পয়সা নিছি কিনা সব
দেখে দিবে।
আমি চুপ করে শুধু দেখে যেতাম।
শ্রুতির আগে ফাতেমাকে দেখলে হয়তো ওকে
ভালোবাসায় আঁকড়ে রাখতাম। বাবা ফাতেমাকে পেয়ে
আনন্দে গদগদ। নিজের মেয়ে পায়নি, তাই হয়তো
ফাতেমাকে দিয়ে সবটা পূরণ করছে।
ফাতেমাও বাবার পছন্দ করা সবকিছু সবসময় করার চেষ্টা
করে। ফাতেমা সংসারে আসার পর থেকে বাড়ির দারুন
পরিবর্তন ঘটেছে। চাকর-বাকর থেকে শুরু করে বাবা
পর্যন্ত সবাই নামাযী হয়েছে।
শুধুমাত্র দু'জন একে অপরের সাথে কথা বলিনা বলে
হয়তো আমাকে বলতে পারে নি। বাড়িতে হয়তো
বাবাকে আর শূন্যতা গ্রাস করতে পারে না। বাবাকে
আনন্দে দেখে বেশ ভালো লাগে আমার।
অফিসের সব কাজ আমার হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আজ তিনি
যে নিশ্চিন্ত। কত করে বললাম অর্ধেকই থাক, কিন্তু কে
শোনে কার কথা। ফাতেমা সবাইকে নিয়ে বেশ সুখেই
আছে। আমি আছি শ্রুতিকে নিয়ে।
বিয়ের কয়েকদিনের মাথায় নিজ হাতে রান্নাবান্নার
কাজ শুরু করে ফাতেমা। প্রথম রান্না খেয়ে বাবা
কিছুক্ষণ থ হয়ে ছিলো। চেটেপুটে খুব দ্রুত খেয়ে
বলেছিলো,
- ঠিক আমার মায়ের মতন রান্না। আহা! মা জননী কি
খাওয়াইলি।
আমার দিকে বাবা আড়চোখে বাবা তাকিয়ে মুচকি
মুচকি হাসছে। বাবার এই চাহনি কথা আমি ঢের বুঝতে
পেলাম। তিনি বলছেন, 'বাবাজি, তোমার জীবন
স্বার্থক।'
আমি একটু রাগত ভঙ্গিতে খাওয়া শুরু করলাম। বাহ! বেশ
রেঁধেছে মেয়েটা। আমি মেকি হেসে বাবার দিকে
তাকালাম।
বুঝতে পেলাম বাবার দিকে দেখলে আবার তার দৃষ্টি
দিয়ে কোন কিছু বোঝাবে। তাই সেদিকে না তাকিয়ে
খাবারটুকু সাবাড় করে অফিসের দিকে ছুটলাম।
আজকাল বাবা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে মাথায় টুপি
দিয়ে বারান্দায় তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় নতুবা
ফুলগাছে পানি দিয়ে সময় কাটায়।
বাবাকে দেখলে সহজেই বোঝা যায় তিনি বহুদিন পর
সুখে আছেন, বেশ সুখে আছেন। হয়তো এই সুখটুকু মহান
আল্লাহ তায়ালা ফাতেমার মাধ্যমে এই সংসারে
পাঠিয়েছেন। বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করার
কয়েকদিন পর বাবা কথার ছলে বলেই ফেললেন, 'রোহান
বাবা এবার বাড়িতে নতুন অতিথি নিয়ে আয়। সংসারটা
আরো ভরে উঠুক।'
বাবা জানে না ফাতেমার সাথে আমার কি সম্পর্কের
বেড়াজাল। এই কয়েকমাসে ফাতেমা ছুঁই নি পর্যন্ত।
.
সেদিন ঘটলো এক আশ্চর্য ঘটনা। আমি গোসল সেরে
মাত্রই রুমে এসেছি, সেসময় ফাতেমা জানালার পাশে
দাঁড়িয়ে ছিলো। দেখলাম বিছানার উপর একটা
ডায়েরী।
ডায়েরীতে সুন্দর করে লেখা,
'আপনার কাছে একটা জিনিষ চাইবো, দিবেন তো?'
আমি উক্ত কথাটার নিচে লিখলাম,
'হ্যাঁ বলো।'
কথাটা লিখেই অন্য সাইটে দাঁড়িলাম। ফাতেমা আমার
সাথে কথা বলে না। আমিও বলি না। হয়তো ও আমার
সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করে কিন্তু আমি সুযোগ
দেইনি।
দেখলাম আমার কথার নিচে লিখলো,
' আপনি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বেন নিয়মিত? আমি তো
আপনার শর্ত পূরণ করছি, আমার একটা আবদার রাখা যায়
না?'
আমি লেখাটা দেখে কিছু না লিখে সকালের নাস্তা
করে অফিসে বের হলাম। মেয়েটা হয়তো কিছুটা দুঃখ
পেয়েছে।
আমার অনুধাবন সঠিক হলো অফিস থেকে ফিরে এসে।
টেবিলের উপর ডায়েরীটা খুললাম, ফাতেমা ঘুমিয়েছে।
ডায়েরীর পাতা যে ভেজা তা সহজেই বুঝতে পেলাম।
লেখাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
বুঝলাম মেয়েটা কেঁদেছে। আমি কোন ভ্রুক্ষেপ না করে
খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সে একবারো আমার দিকে তাকালো না।
এমনিতে কাজের ছলে আমার চারদিকে ঘুরঘুর করতো, আর
আজ! ওর ঘুরঘুর করাটা আমাকে বিরক্ত না লেগে বেশ
ভালোই লাগতো। কিন্তু আজ ঘুরঘুর করাটা বড্ড মিস
করছি।
অফিসে এসে মনটা ভালো লাগছিলো না। বারবার
ফাতেমান শ্যামবর্ণ মুখটা ভেসে আসছিলো।
শ্যামবর্ণ হলেও ফাতেমা দেখতে বেশ। আজ কিছুটা
একটা আমাকে ভাবাচ্ছে, খুব ভাবাচ্ছে।
আজ না হয় কাল তো আল্লাহর আদেশ পালন করতেই হবে।
শুনেছি যুবক বয়সে আমল করলে অনেক বেশিই নেকি
পাওয়া যায়। অন্ধকারের পথ থেকে আলোতে আসলাম।
আমার পরিবর্তন দেখে ছোট্ট একটা চিরকুট লিখলো
ফাতেমা। যা আমি আমার মানিব্যাগে পেয়েছিলাম,
'ধন্যবাদ আমার আবদারটুকু পূরণ করার জন্য। আপনার
পছন্দের তারিফ করতে হয় রোহান সাহেব। আপনার শ্রুতি
দেখতে অনেক সুন্দর।'
শ্রুতির সৌন্দর্যের বর্ণনা দেখে হঠাৎ চোখ গেলে
মানিব্যাগের একটা তাকের দিকে। সেখানে যে শ্রুতির
ছবি রাখা আছে। আমি সরিয়ে রাখতে ভুলে
গিয়েছিলাম।
এজন্য আমার মনে কোন দুঃখ নেই, সে তো জানে
শ্রুতিকে আমি ভালোবাসি, কতটা ভালোবাসি!
আমি শ্রুতির দিকে ঝুঁকে থাকলেও ফাতেমা ঝুঁকেছে
সংসারের দিকে। ভাঙা মচকানো সংসারটাকে আবারো
উদ্ধার করছে। শূন্য বাড়িটা আবারো ভরিয়ে তুলেছে। যে
বাড়িতে সুখের কমতি ছিলো সেখানে আজ সুখের ছায়া
বিরাজমান।
শুধু আমি ফাতেমার পাশে থাকলে হয়তো পরিবেশটা মধুর
হতে পারতো। ফাতেমা সেটা চায়, তাহাজ্জুদের সময় সে
কাঁদে। আমি ঢের বুঝতে পারি।
.
শ্রুতির সাথে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। শ্রুতি বিয়ের
জন্য তাগাদা দিচ্ছে। অথচ আগে বলেছিলো এক বছর পর
বিয়ে করবে। কিন্তু আমার বাবা তো জানে না।
জানলে হয়তো তার মুখের অশান্ত ছাপ ফুটে উঠবে।
ফাতেমার সাথে বিয়ের ৭মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছু
বুঝতে পারছি না কি করবো। বেলকনিতে বসে ভাবছি,
বাবা বাড়িতে নেই। ফাতেমার বাবার সাথে দেখা
করার জন্য গ্রামে গেছে।
আমাকে সবকাজ বুঝে দিয়ে বাবা স্বাধীন। অনেক
পুরোনো আত্মীয় তার জেগে উঠেছে। আমি মনে মনে
ভাবি, 'তিনি এসব করে সুখে থাকলেই আমার সুখ।'
আগামীকাল শ্রুতির সাথে আমার প্রথম রিলেশনশিপ ডে।
সে আমার কাছে স্বর্ণের আংটি আবদার করেছে। টাকা
পয়সার কোন অভাব নেই আমার।
একটা নেকলেস আর আংটি গিফট দিব বলে ভাবছি।
অর্ডার করাও শেষ।
প্রথম রিলেশনশিপ ডে কেমন হবে তা নিয়ে বেশ চিন্তিত
আমি। ফাতেমা ইতিমধ্যে এক কাপ কফি দিয়ে ঘরে শুয়ে
পড়েছে।
আমার দুই পৃথিবী, ভালোবাসার মানুষ শ্রুতি আর বিয়ে
করা বউ ফাতেমা। দু'জনকেই নিয়ে চিন্তিত আমি।
পায়চারী করতে লাগলাম। সবাই ঘুমিয়ে শুধু আমিই জেগে
আছি।
হাঁটতে হাঁটতে বাবার সেই ঘরের সামনে আসলাম।
যেখানে বাবা প্রায় সময় বসে থাকেন। আজকে সাহস
করে ঢুকলাম। সুন্দর করে সাজানো ঘরটাতে চারদিকে
মায়ের ছবি।
কখনো বাবার সাথে বা কখনো ছোট্ট রোহানের সাথে।
সব পুরনো জিনিষপত্র সবটা এই ঘরে। হয়তো বাবা-মায়ের
সাংসারিক জিনিষপত্র হবে।
এতদিনেও বাবা সবকিছু ঠিকঠাক আগলে রেখেছে। আর
আমি! দু'পৃথিবীর চাপে দু'দিকে ঘুরছি।
সত্যিই আমি স্বার্থপর। ফাতেমার কাছে দিনদিন অপরাধ
করেই যাচ্ছি। মেয়েটা নিতান্তই ভালো বলে সবকিছু মুখ
বুঝে সহ্য করে।
হয়তো ফাতেমার জায়গায় অন্যকেউ হলে একদিনে
সংসার করার পরিবর্তে মামলা করে ছেড়ে দিতো।
যাইহোক প্রথম রিলেশনশিপ ডে টা বেশ ভালোভাবেই
হয়ে গেল। শ্রুতি অতিরিক্ত নেকলেসটা পেয়ে আমার
অতি কাছে এসে কিস করার চেষ্টা করছিলো।
কেন জানি কি আমায় নিষেধ করলো। আমি তাকে দূরে
সরিয়ে দিয়ে বললাম,
- এখন সব নয় শ্রুতি, বিয়ের পর।
- এটা মোহ নয় রোহান। আমার ভালোবাসা।
- এসব না হয় বিয়ের পরের জীবনের জন্য তোলা রইলো।
আমার কথায় কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
'রোহান তুমি এত সরল কেন? এজন্যই বুঝি তোমাকে আমার
ভালো লাগে।'
শ্রুতির কথাই কি সত্যি? আসলেই কি আমি সরল?

Comments

Popular posts from this blog

বোনের ভালোবাসা

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ১

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ২