সূর্যের হাসি

ছোটগল্প: সূর্যের হাসি

মসজিদে মসজিদে ফজরের আযান হচ্ছে। বাংলাদেশে
অন্যান্য গ্রামের মানুষজনের মতো শেখপাড়ার মানুষজন
আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠে।
বাড়িতে বাড়িতে নতুন করে জেগে উঠার পর্ব শুরু হলেও
গোলজার মিয়ার বাড়িতে জেগে ওঠার পর্ব সুবহে
সাদিকেই হয়েছে। বড় দুঃচিন্তা নিয়ে গোলজার মিয়া
ঘরের বাইরে পায়চারি করছেন।
ছোট মেয়েটাকে বড় স্বাদ করে বিয়ে দিয়েছেন অল্প
বয়সেই। যার পেটে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে তার
নবাগত শিশু। ফাতেমা নামের মেয়েটির স্বামী ঢাকায়
রিকশা চালিয়ে কোনরকম দিন অতিবাহিত করে।
গ্রামের রীতিমতো প্রথম সন্তান নাকি বাবার বাড়িতেই
হতে হয়। সেজন্য বেশ কিছুদিন থেকে ফাতেমা বাবার
বাড়িতেই আছে।
আজ শেষরাতের দিকে পেটে কিছুটা যন্ত্রনা করছে।
মেয়ের এমন অবস্থায় চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে গেছে
গোলজার মিয়ার। অস্থির অবস্থা নিয়ে ফজরের নামাযে
দাঁড়িয়ে আল্লাহর দরবারে কেঁদে সবকিছু ঠিক করে
দিতে বলেন।
কঠিন মূহুর্তে মেয়েকে হাসপাতালে নেয়ার মতো
সামর্থ্য তার নেই। বাস্তব জীবনের কাছে তিনি যে
পরাজিত। দারিদ্র্যতার কষাঘাতে দিনদিন সংকীর্ণ
স্থান থেকে সংকীর্ণ বাতায়নে পৌঁছে গেছেন তিনি।
অপেক্ষার প্রহর যেন কাটতেই চায় না আজ। অপেক্ষার
রাত নাকি বড় হয়!
অপেক্ষাকে সমাপ্ত করে দিনের আলো ফুটতে শুরু
করেছে। গোলজার মিয়া সাহেরা নামের দাঈ মায়ের
বাড়ির দিকে ছুটে যান। খুব দ্রুত নিয়ে আসলেও কোন
ক্রমেই যেন কাজ হাসিল হয়না। ঘরের ভিতর মেয়ের
আত্মচিৎকারে বুকটা ফেটে যাবার উপক্রম হয় গোলজার
মিয়ার।
বাড়ির আশেপাশে অনেকেই জমায়েত হয়েছে। একেকজন
একেকরকম বুদ্ধি দিচ্ছেন। কারো কথায় ভরসা না পেয়ে
মাটিয়ে বসে পরেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের
দিকে তাকিয়ে দু'ফোঁটা অশ্রু কনা মাটিতে টপ করে
পড়ে যায়।
বিভিন্নজন ডাক্তারকে আনার জন্য বললেও সে সুযোগ
তিনি পান না। হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই।
এমনিতেই দেনার দায়ে গলা ভর্তি পানিতে হাবুডুবু
খাচ্ছেন। মনে মনে দোয়া করতে থাকলেন যেন বাড়িতেই
কাজটা সমাধান হয়।
.
দিন আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ফাতেমার যন্ত্রনা
আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। দাঈমা দ্রুত ঘর থেকে বের
হয়ে গোলজার মিয়াকে ডাক দেয়।
- চাচা, বাচ্চা মাইয়া। বাড়িতে বাচ্চা পয়দা করতে
গেলে বড় ক্ষতি হইবার পারে। মেডিকেলে নেয়ার
ব্যবস্থা করেন। আমি সামাল দিবার পারতাছি না।
- মা তুমি তো সবই জানো, দ্যাখো একটু চেষ্টা করে।
- চাচা অবস্থা সুবিধার না।
সাহেরা বানু শেষ কথাটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে
ঘরের দিকে ছুটে গেল। দুঃচিন্তা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল।
ছলছল চোখে ঘরের এক কোণায় মাথায় হাত দিয়ে আবার
বসে পড়লেন।
হঠাৎ কার যেন সংস্পর্শে ঘোর কাটে গোলজার মিয়ার।
চেয়ে দেখেন মন্টু মিয়া। মন্টু মিয়া গোলজার মিয়াকে
অভয় দিয়ে বলে,
- এত চিন্তে কইরো না। আল্লায় সব সমস্যার সমাধান
কইরা দিব। কমিউনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার আর
আপারে খবর দিছি। যা করন লাগে তারাই অহন করবে।
মন্টু মিয়ার কথা শুনে কয়েকজন মহিলা বিরক্তের সাথে
বলতে লাগলেন,
- কমিউনিটি ক্লিনিকের স্যার, আপায় কি করবো? হেরা
তো শুধু ওষুধ দেয়।
মহিলার কথা শেষ না হতেই বাড়িতে উপস্থিত হয়
নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিকের ডাক্তার।
FWA এর ডাক্তার আপা দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। ডাক্তার
সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে গোলজার মিয়াকে সান্তনা
দিতে লাগলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার আপা বের
হয়ে ডাক্তার সাহেবের সাথে কিছুক্ষণ কি যেন
শলাপরামর্শ করলেন।
ডাক্তার সাহেব দ্রুত একটা রিকশার ব্যবস্থা করতে
বললেন। গোলজার মিয়া চেঁচিয়ে উঠলেন,
- কিন্তু বাবাজী।
- চাচা কোন কিন্তু নয়। ডাক্তার আপায় ফাতেমার লগে
মেডিকেলে যাবে, সব ব্যবস্থা উনিই করে দিবেন।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। পরে সবটা বলছি।
খুব দ্রুত রিকশায় করে ফাতেমাকে হাসপাতালে নেয়া
হলো। ডাক্তার আপা তার সাথে গেলেন। ফাতেমার বয়স
নিতান্তই কম দেখে কিছু রাগান্বিত হলেন ডাক্তার
সাহেব, তিনি বললেন,
- এত কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেয়া আপনার মোটেই
উচিত হয়নি। এসময় ওর নিজেকে গড়ার সময়। এত কম বয়সে
বিয়ে দিয়েছেন বলেই কিন্তু কষ্টটা বেশিই হচ্ছে।
তাছাড়া গর্ভবতী হওয়ার সময় মনে হয় চেকআপ করানো
হয়নি। সেজন্য তার এই অবস্থা।
.
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে বেশ কিছু লোক জড়ো
হয়েছে। সকলেই উৎসুক চাহনি দিয়ে ডাক্তার সাহেবকে
ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে, ডাক্তার
সাহেবকে কেউই কখনো দেখেনি। আর কমিউনিটি
ক্লিনিক শুধু ইনজেকশন আর ওষুধ দেয়ার স্থান।
মন্টু মিয়া সবাইকে জোরে বললেন,
- সবাই শোনেন, কারো কোন সমস্যা হলে সবাই
পরামর্শের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিকে যাবেন।
সেখানকার ডাক্তার আপনাদেরকে পরামর্শ দিবেন।
প্রাথমিক চিকিৎসা হলে সরকারি ওষুধ বিনামূল্যে
প্রদান করবেন।
পিছন থেকে একজন মহিলা ভ্রু-কুঁচকে বলে উঠলো,
- উহ, বিনামূল্যে দেয়! ওষুধ দেয়ার সময় বাক্সে টাকা
দিতে হয়।
ডাক্তার সাহেব এবার মুচকি হাসলেন। অতঃপর বললেন,
- দেখেন চাচী, আপনি যে টাকা দেন তা কিন্তু ওষুধ
বাবদ নেয়া হয় না। সেই টাকা ক্লিনিকের ফান্ডে জমা
হয়। এই আজকের ঘটনাই দেখুন না, ফাতেমার বাবা হত
দরিদ্র। তার বাবার কিন্তু সামর্থ্য নেই তাকে ভালো
কোন ক্লিনিক বা হাসপাতালে ভর্তি করার। আজকে
কিন্তু ফান্ড থেকে কিছু টাকা ফাতেমার চিকিৎসায়
ব্যয় হবে। এজন্য টাকা দিয়ে ওষুধ নেয়ার কথাটা
পুরোপুরি ভুল।
.
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক বলে উঠলো,
- ডাক্তার সাহেব, কমিউনিটি ক্লিনিক তো সরকারি।
এতে ক্লিনিক ফান্ড হবার কি প্রয়োজন?
ডাক্তার সাহেব বললেন,
- তোমার কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। কমিউনিটি ক্লিনিক
পুরোপুরি সরকারি নয়। এতে শুধুমাত্র ওষুধ এবং আমাদের
সম্মানীটুকু সরকারি। বাকিটা কমিউনিটি ক্লিনিক
কমিটির তৈরি ফান্ড থেকেই আসে। ক্লিনিকের ফ্যান,
লাইট, টয়লেট ক্লিনার ইত্যাদি জনগনের দেয়া টাকা
থেকেই আসে।
ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে একজন মহিলা বলে উঠলো,
- আমরা জানি ক্লিনিকে শুধুমাত্র ওষুধ আর নিয়মমাফিক
ইনজেকশন দেয়া হয়। কিন্তু আজকে ফাতেমার ঘটনা
দেখে আমি অবাক হয়েছি। আচ্ছা, কমিউনিটি
ক্লিনিকে আর কী কী সেবা পাওয়া যাবে?
- কমিউনিটি ক্লিনিক ওষুধ দেয়া ছাড়াও অনেক কাজ
করে থাকে। ২০০০ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়া জনগন ও
সরকারি যৌথ প্রযোজনায় পরিচালিত কমিউনিটি
ক্লিনিকে (১) নব দম্পতি, সক্ষম দম্পতি ও গর্ভবতী
মহিলাদের নিবন্ধীককরণ করা হয়।
(২) গর্ভবতী মায়েদের গর্ভকালীন ও প্রসব বেদনার
পরবর্তীকালীন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করা হয়।
(৩) ই পি আই এর পরিচালনায় শিশুদের ও মহিলাদের
প্রতিষেধ টিকা দেয়া হয়।
(৪) ডায়াবেটিক মেপে তার সঠিক পরিচর্যার
দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
(৫) প্রেসার মাপা হয়।
(৬) যক্ষা, ফাইলোরিয়া, কালাজর ইত্যাদি কঠিন রোগের
চিকিৎসার জন্য উচ্চ কেন্দ্র রেফার করা হয়।
(৭) অটিজম কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে বিশেষ
স্বাস্থ্য সেবা।
(৮) কমিউনিটি ক্লিনিকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে
বিশেষ সেবা প্রদান করা হয়।
এছাড়াও জটিল রোগীদের উচ্চ কেন্দ্রে রেফার করে
দেয়া হয়।
.
এতক্ষণ যাবত সবাই ধৈর্যের সাথে ডাক্তার সাহেবের
কথা শুনছিলেন। ডাক্তার সাহেবের কথা শুনে একজন
বলে উঠলো,
- কমিউনিটি ক্লিনিক এতকিছু সেবা দেয়! আগে তো
জানতাম না।
- আজ তো ভালোভাবে জানলেন। এবার থেকে নিশ্চই
নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিকে আসবেন।
- ডাক্তার সাহেব তো ওষুধ থাকতেও দিতে চায় না।
- এ কথাটা চাচী আপনার ভুল। সরকার ডাক্তারকে বসিয়ে
রেখেছেন মানুষের সেবা করার জন্য। তারা কেন
গাফলতি করবে। সরকার থেকে যা ওষুধ আসে তা জনগন
ভোগ করে। আস্তে আস্তে সেটাও ফুরিয়ে যায়। যখন
থাকবে না তখন কোথা থেকে দিব বলেন?
.
ডাক্তার সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে সিসিতে ফিরে
আসেন। মানবতার খাতিরে কাজ করতে পেরে তাদেরও
বেশ আনন্দ অনুভব হয়। প্রতিদিন কত মানুষের উত্থান-পতন
হয় এই কমিউনিটি ক্লিনিকে। কয়জনই বা জানে তার
নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে?
ডাক্তার সাহেব কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করে
কাজে মনোযোগ দেন। গোলজার মিয়ার বাড়িতে বেশ
কিছু সময় কেটে গেছে। সিসি খোলা দেখে রোগীরাও
প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার জন্য আস্তে শুরু করেছে।
এভাবে কাটে এক একজন সিএইচসিপির সপ্তাহে ৬ দিন।
.
৩দিন পর....
কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও
পরামর্শ দিচ্ছিলেন ডাক্তার সাহেব। গোলজার মিয়া
দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
রোগীর ভীরে হয়তো তাকে দেখা হয়নি। হঠাৎ চোখ
গোলজার মিয়ার দিকে যায় ডাক্তার সাহেবের।
- কী খবর গোলজারর চাচা? এদিকে আসেন। দূরে
দাঁড়িয়ে কেন?
গোলজার মিয়া ডাক্তার সাহেবের কাছাকাছি
দাঁড়িয়ে কড়জোড়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,
- বাবাজি, আপনারা না থাকলে হয়তো কষ্ট পেয়ে আমার
মেয়েটা মরেই যেত। সেদিন ঠিক সময়ে গিয়ে বড় উপকার
করেছেন।
- কি যে বলেন চাচামিয়া, এটা আমাদের সকল Chcp এর
দায়িত্ব। মনে করবেন আল্লাহ সরকারের অসিলায় এইসব
সুযোগ-সুবিধার প্রদান করে প্রাথমিক চিকিৎসার
ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তা চাচামিয়া মেয়ের কি
সন্তান হলো?
মুচকি হেসে গোলজার মিয়া বলেন,
- নাতি হইছে ডাক্তার সাহেব।
- এবার কিন্তু কোন ভুল করবেন না। সময়মতো নাতির
নিবন্ধতালিকায় নাম লেখিয়ে পরামর্শ মতন চলবেন। আর
হ্যাঁ ওর মায়ের বয়স কম, যত্ন নিতে হবে ভালো করে।
- তা আর বলতে! এমন ভুল আর হবে না।
গোলজার মিয়া চলে যাচ্ছেন। ডাক্তার সাহেবের মুখে
তৃপ্তির হাসি। সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পুরো
কমিউনিটি ক্লিনিক। কেউ আসছে, আবার কেউ
প্রাথমিক চিকিৎসা হাতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে।
(সমাপ্ত)

Comments

Popular posts from this blog

বোনের ভালোবাসা

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ১

ভালোবাসার গল্প।পর্ব ২